রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৯:০৫ পূর্বাহ্ন
শেখ রোকন:
যদি সোজা-সাপটা বলি, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বসে লেখা নিবন্ধের শিরোনামটি দুর্ভাগ্যজনক। নানা দিক থেকেই দুর্ভাগ্যজনক। ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে সবচেয়ে অগ্রসর ‘বাঙালি’ জনগোষ্ঠীর শত নয়, হাজার নয়, এক লাখও নয়। আসামে অন্তত ৪০ লাখ বাঙালির ‘নাগরিকত্ব’ হুমকির মুখে! অথচ ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালে, অর্থাৎ দেশ বিভাগের সময় সবচেয়ে বেশি মূল্য যারা চুকিয়েছে, তাদের মধ্যে বাঙালি প্রধান। তাদের ঐতিহাসিক ভূমি অখণ্ড বাংলা ভেঙে ভাগ করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার হাজার হাজার নাগরিক নিঃস্ব হয়ে পশ্চিমবঙ্গে গেছেন; আবার একই স্রোত এসেছে পূর্ববঙ্গে। একই ভারতের অংশ আসাম প্রদেশের বাঙালিরা যেন আরও দুর্ভাগা। ভারত স্বাধীন হওয়ার সাত দশক পরও তাদের অনেকে যে নিজভূমে পরবাসী, এই তালিকা তার সর্বশেষ নজির।
নিবন্ধটি যখন লিখছি, তার কয়েক ঘণ্টা আগে সোমবার দুপুরে ভারতের আসাম সরকার উন্মুক্ত করেছে ‘এনআরসি’ বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স। মোট তিন কোটি ২৯ লাখ অধিবাসী আবেদন করেছিল। এর মধ্যে দুই কোটি ৮৯ লাখকে চূড়ান্ত নাগরিকত্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রয়টার্সের খবর, চূড়ান্ত তালিকায় স্থান হয়নি ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জনের।
এই তালিকা প্রকাশ উপলক্ষে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে উপস্থিত ভারতীয় ন্যাশনাল রেজিস্টার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তারা যদিও বলছেন, এই তালিকা খসড়া মাত্র; ৪০ লাখ বাঙালি যে তাতে সামান্যই আশ্বস্ত হতে পারবেন, বলা বাহুল্য। যদিও কর্তারা বলছেন, এই খসড়ার ভিত্তিতে সীমান্ত শাখা, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো সংস্থা আসামের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। যদিও বলছেন যে, কাউকে এখনই ‘ডিটেনশন শিবিরে’ নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। প্রদেশটির বাঙালি জনগোষ্ঠীর পক্ষে আশ্বস্ত হওয়া কঠিন।
আসামের বাঙালিরা আসলে ঘর পোড়া গরু। পঞ্চাশের দশক থেকেই তাদের ‘অরিজিন’ নিয়ে নানা চাপান-উতোরের পর আশির দশকে আসামের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি বা বাংলাভাষী-বিরোধী তৎপরতা শুরু হয়েছিল। তার মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন থেকে শুরু করে গণহত্যাও ছিল। ‘বঙাল খেদা’ প্রপঞ্চের শিকার হয়ে অনেককে আশ্রয় নিতে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গে।
পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তা নানা ধাপ ও মাত্রা পেরিয়ে সোমবারের এনআরসি তালিকা প্রকাশে এসে ঠেকেছে। এর মূলে রয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়। সুপ্রিম কোর্ট আসাম রাজ্য সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছিল ১৯৫১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন ও ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রণীত ভোটার তালিকাগুলোকে বিবেচনা করে ‘এনআরসি’ হালনাগাদের। এই দুই নথি একত্রে ‘লিগ্যাসি ডাটা’ নামে পরিচিত।
এই ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘লিগ্যাসি ডাটা’ কতটা সঠিক? প্রত্যন্ত এলাকাবহুল আসামে পাঁচ দশক আগের তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বল্পতার সময়ে আদমশুমারি ও ভোটার তালিকা কতটা নিখুঁত হয়েছিল? এর মধ্যে অন্য রাজ্য থেকেও জীবন-জীবিকা, সম্পর্ক, এমনকি রাজনীতি সূত্রে অনেক পরিবার বা ব্যক্তি কি আসামে ঠিকানা খুঁজে নেয়নি?
আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে এই তোড়জোড়ের মূলে যে সাম্প্রদায়িকতাই প্রধান, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। গত বছর যখন এই তালিকা তৈরি হচ্ছিল, তখনই দেখা গেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জেসিও হিসেবে ৩০ বছর চাকরির পর অবসর নিয়ে গৌহাটিতে বসবাসের সময় ‘আজমল হক’ নামে একজনকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার সমন পাঠানো হয়েছিল।
এই পরিস্থিতি কেবল আসামের বাঙালিদের জন্য যে দুর্ভাগ্যজনক, তা নয়। বাংলাদেশের বাঙালিদের জন্যও দুশ্চিন্তামূলক। সেই দুশ্চিন্তার পেছনে কেবল স্বজাতির একটি অংশের প্রতি সহমর্মিতাই নেই। ষোলোআনা আশঙ্কার কারণ অন্যত্র। কারণ, অতীতে আসামে ভাষা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা-প্রসূত নাগরিকত্ব ইস্যু যতবারই উঠেছে, ততবারই তাদের সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠানোর অপলাপ চলেছে। অপচেষ্টাও কম ছিল না। দশকের পর দশক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে অহমীয়াদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল করা হয়েছে যে, আসামে ‘বাংলাভাষী’ বা বাঙালি মানেই যেন ‘বাংলাদেশি’। অথচ ভারতেই বাঙালি প্রধান আরও দুটি রাজ্য রয়েছে- পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা। আর এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলাদেশ ও আসাম ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রায় অভিন্ন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আসাম বা ভারত সরকার মনে রাখেনি, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত নৈকট্যের কারণেই বঙ্গভঙ্গের পর ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল।
আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, আসামে যতবারই বাঙালিবিরোধী প্রচারণা ও তৎপরতা চলেছে, ঢাকার দিক থেকে জোরালো প্রতিবাদ হয়নি। অথচ বরাবরই সেখানকার বাংলাভাষী বা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাদের সীমান্তের এপারে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টার কথা তো আগেই বলেছি। আমরা দেখছি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে বরং সোচ্চার ভূমিকা নিয়েছে। গত ডিসেম্বরে যেমন, এবারও তেমনই এভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
একই প্রতিক্রিয়া ঢাকার দিক থেকেও জরুরি। সেই সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। মনে রাখতে হবে, আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দশক দশক ধরে ‘বাঙালি’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছিল; তখন ঢাকা এর কার্যকর প্রতিবাদ করেনি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গা স্রোত ঠেকানো যায়নি। আর আসামের বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিক নৈকট্য তো আরও বেশি। আর আসামের দিক থেকে স্রোত হবে আরও বড়।
ঢাকার উচিত হবে, অবিলম্বে এ ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি জানানো। একই সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক সত্যও মনে করিয়ে দেওয়া। আসামের মনে রাখতে হবে, বাঙালি অধ্যুষিত বরাক ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা ঐতিহাসিকভাবে অখণ্ড বাংলারই অংশ ছিল। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বর্তমান চার জেলা- ধুবরী, গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড়, বঙ্গাইগাঁও সোয়া উনিশ শতক পর্যন্ত ছিল রংপুরের অন্তর্গত। আর বরাক অববাহিকার করিমগঞ্জ, কাছাড়, হাইলাকান্দি জেলা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিল সিলেটের অন্তর্গত। নতুন নাগরিকত্ব নিবন্ধন তালিকায় যারা বাদ পড়েছেন, তাদের বেশিরভাগই এই সাত জেলার বাসিন্দা। ঢাকার দিক থেকে গৌহাটিকে বা দিল্লিকে প্রাঞ্জল ভাষায় মনে করিয়ে দিতে হবে, ওই সাত জেলার বাঙালি বা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী বর্তমান আসামের ‘আদিবাসী’।
মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি, দেশভাগের সময় সব অঞ্চলের মানুষকেই ভারত ও পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। রাজনীতির মারপ্যাঁচে তারা আসামের অংশ হয়েছিল। সিলেটের মতো কিংবা রংপুরের মতো তারা বাংলাদেশের অংশও হতে পারত।
বস্তুত আসাম, ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গে ‘বাঙালি’ বা বাংলাভাষীর অবস্থান এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ধর্ম বা ভাষার কারণে তারা বাংলাদেশি হতে পারে না। আবার ভাষা, ধর্ম ও নৃতত্ত্বের কারণে তাদের দুর্গতির সময় বাংলাদেশ নিশ্চুপও থাকতে পারে না।
skrokon@gmail.com
লেখক ও গবেষক
সুত্র-নয়াদিগন্ত